পরিশ্রমই মর্জিনার ভাগ্য বদলের চাবিকাঠি
পরিশ্রমই জামালপুরের জঙ্গলপাড়া বোর্ডঘর এলাকার বাসিন্দা মর্জিনার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। স্বামী- সন্তান নিয়ে তিনি আজ সাফল্যের সিঁডি বেয়ে উপরে উঠছে। তারা অশিক্ষিত হলেও তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে স্কুলে ভর্তি করেছেন মানুষের মতো মানুষ করতে।
বাঁশের তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য মাছ ধরার পলো, খাঁচা, টুকরি, আদলা খাঁচা, ঢালাই খাঁচা, কুলা, চালুন, হাতপাখা, মাছ ধরার বাইর, কাইঠা বাইর, উছা, ধারাই, পাইপ লাকড়ি, পান-ঢালা, ঝাঁটা, বারুন, ফুলঝাঁড়ু, সিমেন্টর তৈরি চুলাসহ নানা ধরেন সামগ্রী থরে থরে সাজানো মর্জিনার দোকানে।
স্বামী দরিদ্র রিকশাচালক রমজান আলীর অভাবের সংসারে অর্থের যোগান দিতে নিজেই শুরু করেছেন বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য বিক্রির ব্যবসা। এতে যে টাকা আয় হয় তাতে সংসারের অভাব অনটন দূরে ঠেলে আজ তিন সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর জামালপুর পৌরশহরের জংগলপাড়া বোর্ডঘর এলাকার দরিদ্র রিকশাচালকের স্ত্রী মর্জিনা বেগম।
মর্জিনা বেগম বলেন, এসব সামগ্রী তিনি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এসব পণ্য সামগ্রী দোকানে আনা-নেয়ার জন্য স্বামী রমজান শেখকে একটি বেসরকারি ঋণদান প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি পুরাতন অটোরিকশা কিনে দেন। ওই রিকশা দিয়ে স্বামী ও মর্জিনা জামালপুর জেলার ঢেংগারগড়, শাহ্বাজপুর, ছুইনটা বাজার, কালীবাড়ি, নান্দিনা, বেড়াপাথালিয়া, জেলার মেলান্দহ ও ইসলামপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশের তৈরি নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দোকানে এনে তা বিক্রি করছেন। এতে ধীরে ধীরে তাদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। মর্জিনার দোকানে এখন প্রতি দিন গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়।
মর্জিনা বেগমের ১৯৯৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া কালীবাড়ী দামেশ্বর এলাকার মৃত রসুল শেখের ছেলে দরিদ্র রিকশাচালক রমজান শেখের সঙ্গে বিয়ে হয়। অভাব অনটনে বেড়ে ওঠা মর্জিনা বিয়ের পর আরেক দরিদ্র পরিবারের বউ হয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েন। স্বামী রমজান সে সময় অন্যের রিকশা ভাড়ায় চালাতেন। সারাদিন রিকশা চালিয়ে আয়ের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো রমজানকে।
এভাবে সারাক্ষণ অভাবের সংসারের কথা চিন্তা করতে করতে বিয়ের কিছু দিন পর স্বামী রমজান শেখ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সে সময় মর্জিনার প্রচেষ্টায় ধারদেনা করে চলে তার চিকিৎসা। সে যাত্রায় স্বামী রমজান প্রাণে বেঁচে গেলেও চিকিৎসকের পরামর্শে রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরেন নববধূ মর্জিনা। এক পর্যায়ে পরের বাড়িতে মাসিক ৫শ টাকা বেতনে ঝিঁয়ের কাজ শুরু করেন।
সারাদিন কাজ করে যা পান তাতে কোনভাবেই সংসার চলে না। ওই সময় আরো বেশ কয়েকটি কাজ যোগাড় করে নেন। সকাল থেকে রাত অবধি চলে মর্জিনার হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সেখান থেকে যা পান তার মধ্য থেকে সামান্য কিছু সঞ্চয় করে তা দিয়ে মর্জিনা পাঁচটি ছোট দেশী মুরগির বাচ্চা কিনেন। ধীরে ধীরে সেই বাচ্চা বড় হয়ে ডিম দেওয়া শুরু করে। সেই ডিমের টাকা জমিয়ে মর্জিনা কিছু হাঁস কিনেন। পরবর্তীতে সেগুলো বড় হলে মর্জিনা তা বিক্রি করে আরো কিছু টাকা যোগ করে একটি বাছুর গরু কিনেন।
ধীরে ধীরে ওই গরু সামান্য বড় হলে সেটি ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেন মর্জিনা। পরে জঙ্গলপাড়া বোর্ডঘর এলাকায় ২০০৯ সালে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে বাঁশেন তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের বেঁচা-কেনা শুরু করেন।
মর্জিনার দোকানে কুলা কিনতে আসা জিগাতলা এলাকার বাসিন্দা গৃহিনী রুপসী আক্তার বলেন, নারীরা এখন আর পর-নির্ভরশীল নয়। তারাও যে পরিশ্রম করতে পারে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে মর্জিনা বেগম তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কষ্টের পর বর্তমানে কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখছেন মর্জিনা।
মর্জিনা বলেন, আমি এবং আমার স্বামী দুজনই নিরক্ষর। আমরা লেখাপাড়া জানি না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত কষ্টই হউক না কেন, আমরা আমাদের সন্তাদের নিরক্ষর রাখবো না। তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবো। মর্জিনার ঘরে দুই ছেলে, এক মেয়ে।
তার মেঝো মেয়ে জান্নাতারা স্থানীয় জে ডি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে ওর রোল এক। বড় ছেলে মুস্রারাফিলও একই স্কুলের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র। আর ছোট ছেলে মুত্তাকিম স্থানীয় একটি মাদরাসায় পড়ে। মর্জিনা বেগম পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তার ভাইয়ের কাছ থেকে এক শতাংশ জমি ক্রয় করে তাতে ছোট্ট একটি ঘর তুলে সপরিবারে বসবাস করে আসছেন। তার চিন্তা, তিন সন্তানকে তিনি পরিপূর্ণভাবে শিক্ষিত, আদর্শ ও নিষ্ঠাবান সৎ নাগরিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
সমাজসেবক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, সমাজে কোনো কাজই ছোট নয়। ছোট ছোট বালু কোনা থেকেই পাহাড়ের সৃষ্টি। মর্জিনা তার নিজ শ্রমের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করেছেন যে, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সমাজের প্রতিটি নর-নারী অসল সময় না কাটিয়ে পরিশ্রম করলে তার ভাগ্যের চাকা একদিন ঘুরে দাঁড়াবে এটাই বাস্তব।