ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কিংবদন্তি ফুটবলার থেকে স্বৈরশাসকের ‘গলার কাঁটা’ হয়েছিলেন সক্রেটিস

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১০ আগস্ট ২০২৪

কিংবদন্তি ফুটবলার থেকে স্বৈরশাসকের ‘গলার কাঁটা’ হয়েছিলেন সক্রেটিস

কিংবদন্তি ফুটবলার থেকে স্বৈরশাসকের ‘গলার কাঁটা’ হয়েছিলেন সক্রেটিস

ফুটবলের দেশ হিসেবে ব্রাজিলের রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। লাতিন অঞ্চলের দেশটি থেকে যুগে যুগে অসংখ্য তারকা ফুটবলারের আগমন ঘটেছে। তবে ফুটবলের উর্বর জমিতেও সেনাবাহিনীর স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিলেন ব্রাজিলিয়ানরা। 
সময়টা ছিল ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাস। সামরিক জান্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গণতন্ত্র ফেরাতে ধীরে ধীরে আগাবে। কিন্তু মুক্তিপাগল জনগণ স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল থেকে বেরোতে শুরু করছিল বিশাল প্রতিবাদ, দ্রুততম সময়ে চেয়েছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।   

অগ্নিঝরা সেই সময়ে ‘ডাইরেটাস জা’ অর্থাৎ এখনই সুষ্ঠু নির্বাচন নামের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি  জড়িয়ে পড়লেন সেলেসাওদের কিংবদন্তি  ফুটবলার সক্রেটিসও। এ ঘটনা তার জীবনের মহান রাজনৈতিক মুহূর্ত হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে যায়।

সক্রেটিসের বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী। গ্রীক দর্শনের একজন আগ্রহী পাঠক হওয়ায় দার্শনিক সক্রেটিসের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়ার পর পারিবারিকভাবে নাম রাখা হয়েছিল সক্রেটিস ব্রাজিলিরো সাম্পাইও দে সুজা ভিয়েরা দে অলিভেইরা। ডাক্তার হিসেবে প্রশিক্ষিত হওয়ায় তার ডাকনাম ছিল ডাউটর সক্রেটিস।

মুখের দাড়ি এবং কপালে হেডব্যান্ড লাগানোর জন্য সক্রেটিস তার খেলোয়াড়ি জীবনে হয়ে ওঠেন পুরো প্রজন্মের ফুটবল সমর্থকদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ও শীতলতার প্রতীক। 

১৯৮৩ সালে সক্রেটিস বর্ষসেরা দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলার নির্বাচিত হন। কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে ২০০৪ সালে তাকে বিশ্বের সেরা জীবিত খেলোয়াড়দের ১০০ জনের তালিকায় রেখেছিলেন।

১৯৬৪ সালের ১৫ মার্চ ব্রাজিলে সামরিক শাসনের সূচনা। সেন্সরশিপের থাবা পড়েছিল বহু বইয়ের উপর। নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘মুক্তমনা’ বলে পরিচিত বহু লেখকের বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিজের বাবাকে লাইব্রেরিতে পুড়িয়ে দেওয়া বইগুলো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছিলেন সক্রেটিস। দশ বছরের বালকের মনে মর্মান্তিক এই ঘটনা ভীষণভাবে দাগ কাটে। সামরিক শাসনের ভেতর বেড়ে উঠতে থাকা সক্রেটিসের তাই স্বৈরশাসনের সমালোচনা করার অভ্যাস ছিল।   

সরকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠল ব্রাজিলের জনপ্রিয় ক্লাব ‘করিন্থিয়ান্স’। তার আগে থেকেই এখানে তৈরি হয়েছিল সামরিক শাসনের প্রতিবাদী মঞ্চ ‘কোরিন্থিয়ান্স ডেমোক্র্যাসি মুভমেন্ট’। সক্রেটিস ছিলেন এটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করেছিলেন। পরে স্বৈরাচারের অবসানে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের অগ্রভাগের সৈনিক হন।

১৯৮৪ সালের ১৬ এপ্রিল, করিন্থিয়ান্স ক্লাবের সতীর্থদের সঙ্গে সাড়া জাগানো বিশাল দিরেটাস জা সমাবেশের অন্যতম নায়ক বনে যান সক্রেটিস। অংশগ্রহণকারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে ছিলেন ব্রাজিলে বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বরত লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা।

সেদিন সাও পাওলোতে সামরিক শাসনের ফলে ক্ষমতাবান জেনারেলদের সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে বিশাল গণবিক্ষোভ হয়েছিল। এর আগে মার্চে রিও ডি জেনেইরো, বেলো হরিজন্তে এবং অন্যান্য শহরে  গণবিক্ষোভের দেখা মেলে।

সমাবেশে বামপন্থী সক্রেটিস মঞ্চে সেই সময়ে গণতন্ত্রের প্রতীক একটি হলুদ টি-শার্ট পরিহিত অবস্থায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘যদি সংসদীয় সংশোধনী যা রাষ্ট্রপতির জন্য সরাসরি নির্বাচনের অনুমতি দেয়, তাহলে আমি ইতালিতে খেলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করব।’

‘ডক্টর সক্রেটিস’ নামক আত্মজীবনী বইয়ের লেখক সাংবাদিক অ্যান্ড্রু ডাউনি বিষয়টি নিয়ে বলেন, আমার সন্দেহ ছিল তিনি সমাবেশে উত্তেজিত জনতা দেখার পর তাৎক্ষনিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি এমন খেলোয়াড়ের একজন ছিলেন, যিনি নীতি এবং জীবনকে অর্থের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেখেছিলেন। গণতন্ত্রে উত্তরণে অংশ নিতে ইতালিতে খেলার জন্য লাখ লাখ টাকা উপার্জনকে ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিলেন।

সমাবেশের কয়েকদিন পর সাংবাদিক জুকা কফৌরিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সক্রেটিস বলেছিলেন, আমি পুনর্গঠনে অংশ নিতে আমার দেশে থাকতে চাই। এটি একজন ফুটবল খেলোয়াড় ঝাড়ুদার, প্লাম্বার বা ডাক্তার যেমন কাজই হোক।

বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বাদ কখনো না পেলেও মিডফিল্ডার হিসেবে সক্রেটিস ছিলেন দুর্দান্ত। ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটি সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড হিসেবেও খেলেছেন। মার্জিত, প্রতিভাবান এবং কৌশলী প্লেমেকার হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয়। দুর্দান্ত পাস, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে লম্বাভাবে বল বাড়ানো, মাঠে তার দৃষ্টিশক্তি ও শারীরিক সামর্থ্য ছিল নজরকাড়া। দুই পায়েই সমানতালে ও শক্তিতে ছিল ভারসাম্য। গোল স্কোরার তো ছিলেনই, ডানপায়ের শক্তিশালী ও নির্ভুল শটের কল্যাণে রক্ষণভাগ থেকে আক্রমণ গড়ায় তার ক্ষমতা ছিল এককথায় অসাধারণ। শারীরিক উচ্চতা কাজে লাগিয়ে হেডে লক্ষ্যভেদে ছিলেন পটু। পেনাল্টি কিক নেয়ার সময় তার উপর দলের  আস্থাশীলতা বহুবার দেখা গেছে।

ফুটবলার হিসেবে খুব দ্রুতগতির ছিলেন না। ধীরগতিতে খেলা পছন্দ করতেন, ছন্দটা ধরে রাখতেন। তার বুদ্ধিমত্তা এবং খেলার পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতাটা ব্রাজিলের জন্য ছিল বেশ মূল্যবান। না তাকিয়ে ব্যাক-হিল পাস দেওয়াটা ছিল বিশেষ ট্রেডমার্ক । ১৯৭৯ সালে জাতীয় দলের হয়ে তার অভিষেক হয়। মোট ৬০ ম্যাচ খেলে সেলেসাওদের হয়ে করেন ২২ গোল।  

১৯৮২ সালে বিশ্বকাপে যখন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে সক্রেটিস নামছেন, তখন তার নামের পাশে এক অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান। ব্রাজিল তার নেতৃত্বে ৩৫টি ম্যাচের মধ্যে ৩৩টিতে অপ্রতিরোধ্য। মাত্র দু’টি ম্যাচে হার। যদিও ট্রফিটা জেতা হয়নি। 

চার বছর পর ১৯৮৬ বিশ্বকাপেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, দর্শকরা দেখেন স্বপ্নের খেলা। পেনাল্টি শ্যুটআউটে গোল মিস করেছিলেন । সেবার ডিয়েগো মারাডোনা বিশ্বনায়ক হয়ে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জেতালেও সক্রেটিসকে নিয়েও কম চর্চা হয়নি। কারণ মেক্সিকোতে আয়োজিত সেই আসরে ‘ইয়েস টু লাভ, নো টু টেরর’লেখা বার্তাবহ হেয়ারব্যান্ড পরেই মাঠ কাঁপিয়েছিলেন ঝাঁকড়া চুলের ব্রাজিলিয়ান তারকা। তখন লিবিয়াতে কেবল বোমাবর্ষণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, প্রাণ হারিয়েছিল অজস্র মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের এই অমানিবিক আচরণে চুপ ছিল দুনিয়ার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী। সেখানে ফুটবলার হয়ে কেউ প্রতিবাদে সামিল হতে পারেন এমনটা কারোর কল্পনাতেই ছিল না।  

১৯৭৪ সাল থেকে ব্রাজিলের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলেন। পরিসংখ্যান বলছে, বোতাফোগো এসপি, করিন্থিয়ান্স, ফিওরেন্টিনা, ফ্লামেঙ্গো, সান্তোসের মতো ব্রাজিলের প্রথম সারির নানা দলের হয়ে ১৫৮ ম্যাচে খেলে ৭৬টি গোল করেন।

ডাক্তারি অধ্যয়নরত অবস্থাতেই পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করেন সক্রেটিস। সবসময় পার্টি করতে পছন্দ করতেন। ঘনঘন বার এবং নাইট ক্লাবে যেতেন। নিয়মিত ধূমপান ও মদ্যপান করলেও ফুটবলার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে এসব কর্মকাণ্ড প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি।  অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষটির শরীরে একসময় বাসা বাঁধে লিভার সিরোসিস।

২০১৪ সালে ব্রাজিলে বসেছিল ফুটবলের মহাযজ্ঞ। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ দেখতে উদগ্রীব ছিলেন সক্রেটিস। সময় যতো গড়াচ্ছিল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ৫৭ বছর বয়সে তার বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হয়ে। নিজ দেশে বিশ্বকাপ দেখার আশা এই মহান বিপ্লবীর অপূর্ণ থেকে যায়।